আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, ‘দেশকে উন্নত করতে হলে নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে’। আমরা জানি সুস্বাস্থ্যের জন্য, দেহকে সুস্থ-সবল রাখতে ফলের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক মোট খাদ্যশক্তি চাহিদা ২৪৩০ কিলোক্যালরি। এর মধ্যে কমপক্ষে ২.৫% ফল থেকে আসা উচিত। কিন্তু আমরা গড়ে ফল থেকে পাচ্ছি মাত্র ১%।
বাংলাদেশে পেটে ক্ষুধা নিয়ে এখন আর কোনো মানুষ রাতে ঘুমাতে যায় না। বর্তমান সরকারের সময়োচিত সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে দানাজাতীয় খাদ্যে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে, দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩% এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। এভাবে সব ধরনের ভিটামিনেরই ঘাটতি চিত্র ফুটে উঠেছে। এর ফলে এখনও পাঁচ বছর বয়সের নিচের শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৩ জন, নিম্ন ওজনসম্পন্ন শিশুর হার ৩৬.৪ শতাংশ এবং মাতৃ মৃত্যুর হার শতকরা ১.৯৪ শতাংশ। ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। খর্বকায় শিশুর হার ৩৬% এবং কৃশকায় শিশুর হারও ১৪%। ধারাবাহিকভাবে তীব্র অপুষ্টির শিকার হলে বয়সের তুলনায় শিশুরা খর্বকায় হয়। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা নয়। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন রকম শাকসবজি ও ফলমূলের সরবরাহ আছে। যা দ্বারা সব ধরনের পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব। এসব ফসলের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সক্ষমতাও আছে উৎপাদন বাড়ানোর। তাইতো প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে উল্লিখিত পুষ্টিহীনতার কারণ কি? মূল সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা হলো আমাদের খাদ্য গ্রহণ অভ্যাসের। আমাদের পুষ্টি সচেতনতার অভাব। শুধু ভাত আর একটু তরিতরকারি হলেই আমরা খুশি। এই মানসিকতার জন্যই আমরা আজ পুষ্টিহীনতার শিকার, অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণের কারণে আমরা স্থূলকায় ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছি। এ অভিমত চিকিৎসকদের। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগী এখন শতকরা ৭.৯ ভাগ এবং স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা শতকরা ৩৯ ভাগ। এ দুরাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ক্যালরি হিসাব করে খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমরা অনেকেই জানি না যে, আমাদের কত ক্যালরি খাবার খেতে হবে। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বাংলাদেশের একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন ২৪৩০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ২০০০ কিলোক্যালরি। তবে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসে ১৫০ এবং পরের ৩ মাসে আরও ৩০০ কিলোক্যালরি করে খাবার বৃদ্ধি করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে।
আমরা অনেকেই জানি না যে, একটা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের সময় হলো ৫ বছর বয়স পর্যন্ত। এই সময়ে যদি শিশুদের সঠিক পরিমাণে সুষম খাবার না দেয়া হয় তবে তাদের পুষ্টি ঘাটতির ফলে কম মেধা নিয়ে তারা বেড়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে আমাদের পরিবার বা জাতীয় পর্যায়ে তার অবদান রাখার ক্ষমতা কমে যায় এবং এ ঘাটতি আজও আমরা বয়ে চলেছি। এ থেকে উত্তোরণের একমাত্র উপায় হলো জাতিকে পুষ্টি শিক্ষাসহ সুশিক্ষিত করা। এ কাজটি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরাই করতে পারি। কারণ আমরাই সব ধরনের খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এবং এ খাতে নিয়োজিত শ্রম শক্তি এখনও ৪৫.১%। এ ৪৫% জনশক্তি, গ্রামীণ মহিলা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের যদি সঠিকভাবে পুষ্টি শিক্ষা দেয়া যায় তবে আমাদের দেশের জনগণের পুষ্টিহীনতা দূর হতে বেশি সময় লাগবে না। যে তিন শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হলো এরা সবাই কিন্তু আমাদের সীমার মধ্যেই থাকে। সবার পক্ষে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকতা করা সম্ভব না। কিন্তু স্কুল প্রাঙ্গণে শাকসবজি, ফল চাষের যে কোনো মডেলের একটা প্রদর্শনী দিয়ে শিক্ষক ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পুষ্টি শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। উপজেলায় যে প্রশিক্ষণগুলো হয় সেগুলোর স্থান ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়।
উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বারটান) কার্যক্রমে ব্যাপক বিস্তৃতি সাধন ও গতি সঞ্চারের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধি ও পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলার এক মহতী কর্মকা- হাতে নিয়েছে।
এছাড়াও ডিএই’র মাধ্যমে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য-
১. ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্প;
২. দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্প;
৩. ইন্টগ্রেটেড এ এগ্রিকালচার প্রডাক্টিভিটি প্রকল্প;
৪. পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প;
৫. সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প;
৬. সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রকল্প;
৭. সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প;
৮. মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প;
৯. ‘পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলায় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে আধুনিক কলাকৌশল হস্তান্তর’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
অধিকন্তু ‘সমম্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা’ (আইপিএম) কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে ফল উপাদনে জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জনপ্রিয় করা হচ্ছে।
দেশে দারিদ্র্য হার কমতির দিকে এবং এ হার ২০০৫ সালে ছিল ৪০ শতাংশ, সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ ও জনগণের পরিশ্রমে এ হার এখন ২৪.৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। যদি অন্য দিক দিয়ে বলি, তাহলে বলা যায় যে, ৭৫.৫৩ ভাগ মানুষ আর দরিদ্র নেই অর্থাৎ তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মতো ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা এখন ৭৫ শতাংশের বেশি।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন করে পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটের প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়। এ খাতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী কিন্তু আমাদের মধ্যেই থাকে। তাদের সঠিক প্রযুক্তি দিয়ে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা গেলে পুষ্টিমান বাড়ানো সম্ভব হবে। এসব খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সরকারি পদক্ষেপের কোনো ঘাটতি নেই। পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসল চাষ উৎসাহিত করার জন্য কৃষি ঋণ বিতরণের গত বছর লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে, যেখানে আমাদের আরও বেশি পরিমাণে সম্পৃক্ত থেকে ঋণ বিতরণ ও তার সঠিক ব্যবহার উৎসাহিত করার সুযোগ ছিল। এখানে আমাদের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার প্রদত্ত ৯০০০ কোটি টাকার ভর্তুকির উপকরণ যেন সঠিকভাবে ব্যবহার হয় তার নিশ্চয়তার জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষিভিত্তিক কাঁচামালের সরবরাহও বাড়বে। প্রক্রিয়াজাত পণ্য সহজলভ্য হলে বিদেশি পানীয়সহ অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতপণ্য আমদানি কমবে, ব্যবহার কমবে এবং গুণগতমানসম্পন্ন দেশীয় পণ্যের সহজলভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তার পরিমাণও বাড়বে, যা পুষ্টিহীনতা দূর করতে সহায়তা করবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এর ২ ও ৩ নং ক্রমিকে ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ্য অর্জন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা চালু এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংকল্পবদ্ধ। এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে প্রতিদিন সুষম খাবার খেতে হবে। আমাদের দেশে সব মৌসুমে কোনো না কোনো ফলের উৎপাদন হয়ই। এসব ফল পুষ্টিসমৃদ্ধ। বিদেশি ফলের চেয়ে এসব দেশি ফলের দামও কম। সরকার এরই মধ্যে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বছরব্যাপী দেশি ফলের জোগান নিশ্চিত করা। প্রতিটি বসতবাড়ি এবং বাড়ির ছাদে দেশি ফলের ভাণ্ডার গড়ে তোলা এবং জনগণের মধ্যে নিয়মিত এবং পরিমাণমতো দেশি ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করা। এসব ফল চাষ করে একদিকে যেমন দেশে বসবাসকারী জনসাধারণের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করা যায়, আবার বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। দেশি ফলের মধ্যে কলা, পেঁপে, পেয়ারা, কাগজিলেবু বাড়ির আঙিনায় চাষ করা যায় এবং সারা বছর ফল পাওয়া যায়। আম, আনারস, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, জাম, জামরুল, সফেদা, আমড়া, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, বেল, কদবেল, আমলকী, তাল, খেজুর, চালতা, ডেউয়া, কাউফল, গাব, বেতফল প্রভৃতি ফল এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। পুষ্টি ঘাটতি পূরণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় দুটির জন্যই মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন করতে হবে। অপুষ্ট ফল কোনো অবস্থাতেই আহরণ করে বাজারজাত করা যাবে না। দেশি ফল বেশি করে চাষ করতে হবে। নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে সরকার বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের চাহিদা মোতাবেক মানসম্পন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য সরকারের দেয়া দায়িত্বগুলো পরিপূর্ণভাবে পালনে সচেষ্ট আছে এবং থাকবে।
পরিসংখ্যানের উৎস
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫, এফএও, HIES (Household Income and Expenditure Survey) ২০১৪, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যমেয়াদি মূল্যায়ন ২০১৫, ইউএনডিপি বাংলাদেশ ২০১৪, জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১৪, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে ২০১১, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ২০১১, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪।
কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫